প্রকাশিত: Fri, Dec 16, 2022 3:55 PM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 6:34 AM

বিচারের বাণী ‘গুম’ হয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে!

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরেও (আবরারকে পিটিয়ে হত্যার পরে) ছাত্রলীগের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্পষ্ট বিরোধিতা করা ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। যে সম্ভাব্য (নিশ্চিত নয়) ভাড়াটিয়া খুনিকে (সিটি শাহীন) দিয়ে ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে, ঠিক তাকেই ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। এখানে একটা নয়, দুটো ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পিত খুন সংঘটিত হবার অভিযোগ আছে। বাংলাদেশের মিডিয়া যারা কথায় কথায় ‘বাস্তব ঘটনা’কে অভিযোগ আকারে উপস্থাপন করে, তাঁরা ফারদিন হত্যার অভিযোগটি বিষয়ে কিছুই বলতে পারছে না। ইনিয়ে বিনিয়ে ভনিতা কেন্দ্রিক এমন অন্ধকার সাংবাদিকতার যুগ কবে শেষ হবে, আমরা সেটা দেশের সম্পদক পরিষদকে প্রশ্ন করতে পারি। 

আগামী ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ বুয়েটের এলামনি এসোসিয়েশান সাবেক বুয়েটিয়ানদের একটা গ্র্যান্ড পুনর্মিলনী আয়োজন করতে যাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এলামনাই এসোসিয়েশকে ফারদিন হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য এবং একটি নিন্দা প্রস্তাব তৈরির জন্য দৃঢ়ভাবে সুপারিশ করছি। জাতীয় বিকলাঙ্গতা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে আমি মনে করিনা, দেশের কথিত শীর্ষ মেধাবী বলে খ্যাত পেশাজীবিরা কেউ সেখানে প্রতিবাদ করবেন। ফারদিনের সম্ভাব্য (নিশ্চিত নয়) কন্ট্রাক্ট মার্ডারার সিটি শাহীনের স্ত্রী ফারদিন হত্যার ঘটনায় শাহীন ‘কোনোভাবেই’ জড়িত নন বলে দাবি করেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বুয়েটের যে ছেলেটা মারা গেছে তাঁর সঙ্গে আমার স্বামীর কোনো সম্পর্ক নাই। আমি যাতে র‌্যাবের এই হত্যার বিচার চাইতে না পারি, সেইজন্য ঘটনা এইদিকে নিছে’। 

ইতি বলেছেন, ধরলাম আমার স্বামী ওই ছেলেরে (ফারদিন) খুন করছে। কিন্তু আমার স্বামীর মুখের জবানবন্দি তো নিবো। আমার স্বামীর বিচার আদালত করব, আইনে করবো, র‌্যাবে কেন হত্যা করব। আমার স্বামী খারাপ মানলাম, আইনে তার বিচার হইতো। র‌্যাব মারলো কেন? এইটা কেমন বিচার? আফসোস এই যে। শিশু বাচ্চার মা এই সাধারণ নারী ন্যায়বিচার ও বিচারের অধিকার সম্পর্কে যা বোঝেন, তা আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন-সরকার, আমলা-মন্ত্রী এবং বুদ্ধিজীবীরাও বোঝে না। এই না বুঝনেওয়ালারাই আবার দেশের স্বৈরশাসকের কোন বিকল্প নেই সেটা কিন্তু ভালো বুঝেন। প্রথমে মাদক, পরে বান্ধবীর চক্রের বহু সাজানো গল্প শেষে আজ দেশের ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ দিবসে এসে বলা হচ্ছে ফারদিন আত্মহত্যা করেছে। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের বিচার ও তদন্ত ব্যবস্থা। যদিও  ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকের বক্তব্য ছিলো ‘ফারদিনকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তাঁর বুকের দুপাশে দুই-তিনটি ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন আমরা পেয়েছি। পাশাপাশি তাঁর মাথায় চার-পাঁচটি আঘাতের চিহ্ন ছিল। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। (সিভিল সার্জন এএফএম মশিউর রহমান)। অর্থাৎ চিকিৎসকরা ধারণা করেছেন তাকে হত্যা করা হয়েছে।

বেওয়ারিশ লাশ দাফনের ইসলামি দাতব্য সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম জানায়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি ১ তারিখ থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই ৫ বছরে ৬ হাজার ২১৩ জনকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করেছে তারা। অর্থাৎ প্রতি বছরে এক হাজার জনের বেশি মানুষ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে যাদের কোনো ওয়ারিশ পাওয়া যায়নি। শীতলক্ষ্যায় ফারদিনের বস্তাবন্দী লাশ পাওয়া গেছে। বর্তমান শাসনামলে মাঠে ঘাটে ডোবায় ডাস্টবিনে নদী খালে বিলে পাওয়া লাশের মিছিলে ফারদিন একটি নাম মাত্র। লাশগুলো আত্মহত্যা করে নিজেদের বস্তাবন্দী করে দুরের কোন নদীতে নিজেদের ফেলে আসে। তবে মানবাধিকার সংস্থা গুলো বলেছে ১২ বছরে  অন্তত ৬০০ মানুষ গুম হয়েছে এবং ২০০০ মানুষকে বিচার বহির্ভুত হত্যা করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে বলি, ৭ ডিসেম্বর ২০২২ বিএনপি কর্যালয়ে পুলিশের হামলা ও গুলিতে নিহত জনাব মকবুলের স্ত্রী বলেছেন- ‘উনি মামলা করবেন না, কারণ উনি মনে করেন, বিচার পাবেন না’। এর আগের প্রখ্যাত এক অধ্যাপক নিজের ছেলের খুনের বিচার প্রশ্নে বলেছেন তাঁর ধারনা তিনি বিচার পাবেন না। বাস্তবেও তাই ঘটেছে, খুনিদেরকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। হ্যাঁ এই দেশ আমাদেরই, বিচারহীন মৃত্যুর এক সাক্ষাৎ উপত্যকা। বাংলাদেশে বিচার পাবার অধিকার শুধু প্রবল প্রতাপশালী ক্ষমতাসীনদের। কয়েকটা ক্ষেত্রে উনি চান জানানো হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার পাওয়া যায়নি। আগে বলা হতো, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আজকের বাংলাদেশে বিচারের বাণীও গুম হয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে, কাঁদবে  কে? আজকে কাঁদবে ফারদিনের বাবা, মকবুলের স্ত্রী সন্তানরা। আজকে কাঁদবে ক্ষমতাহীন। তাদের কাঁদতে হবে  হাশরের মাঠ পর্যন্ত। ধরনী দ্বিধা হও। ফেসবুক থেকে